জীবন সৃষ্টির রহস্য

সব জায়গাতেই বিতর্ক থাকে। পৃথিবীর বয়স যখন এক লক্ষ কোটি বছর চলছিল তখন এর অবস্থাটা কেমন ছিল? এই প্রশ্নেরও বিতর্কিত জবাব রয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় পৃথিবীপৃষ্ঠ কি গলিত ছিল? তখন বায়ু মণ্ডলে কি অ্যামোনিয়া কিংবা মিথেনের মতো কোন গ্যাসের উপস্থিতি ছিল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরও বিজ্ঞানীরা একই প্ল্যাটফর্মে দাঁর করাতে পারেননি। 

কিন্তু যাই হোক না কেন, কিছু বিষয়ে পণ্ডিতেরা এক মত হয়েছেন। যেমন সকলেই এই বিষয়গুলোতে এক মত যে, পৃথিবী তার প্রাথমিক সময়ে স্থিতিশীল ছিল না। সর্বত্র আগ্নেয় গিরির অগ্ন্যুৎপাত ছিল। বজ্রপাতের আধিক্য ছিল। মুষল ধারায় বৃষ্টি হত তখন। আজকের দিনে যেমন সূর্য অতিবেগুনী রশ্মি বিকিরণ করে, তখনকার দিন গুলিতেও সেই অবস্থা ছিল। সেই রশ্মিকে আমাদের বর্তমান পৃথিবী কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করে ওজন স্তরের সাহায্যে। এই ওজন স্তরের অস্তিত্ব প্রাক-পৃথিবীতে ছিল না। সুতরাং, অতিবেগুনী রশ্মি সরাসরি পৃথিবী পৃষ্ঠে এসে পড়ত। আর তখন বায়ু মণ্ডলে মুক্ত অক্সিজেনের মাত্রা ছিল খুবই কম। এটা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের অজানা নয় যে অতিবেগুনী রশ্মির আলোক রাসায়নিক শক্তি রয়েছে। এই শক্তি অণুকে বিক্রিয়ারত অবস্থায় থাকতে সহায়তা দেয়। এ ধরণের অবস্থা রাসায়নিক সাম্যাবস্থাকে ব্যাহত করে। অর্থাৎ, শুরুর দিকের অস্থিতিশীল পৃথিবীর জন্য দায়ী অতিবেগুনী রশ্মি। 

ছোট্ট এবং সাধারণ জৈব অণুগুলি এরকম পরিস্থিতিতেই সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এর সত্যতা কোথায়? বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে এর সত্যতা খুঁজে পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা কি পরীক্ষা করেছেন পরীক্ষাগারে? যদি CO2, CH4, NH3এবং H2 এই গ্যাসগুলোকে একত্রে মিশ্রিত করে উত্তপ্ত করা যায় এবং একই সাথে এর মধ্য দিয়ে যদি অতি বেগুনী রশ্মি প্রবাহিত করা যায় তাহলে অণুগুলো বিক্রিয়া করবে। বিক্রিয়ার ফলাফল সম্পর্কে ধারণা করতে পারছেন কি? 

বিক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে তৈরি হবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জৈব অণু! যাদের মধ্যে অন্যতম দুটি জৈব অণুর নাম হচ্ছে হাইড্রোজেন সায়ানাইড(HCN) এবং ফরমালডিহাইড(HCHO)। জলীয় দ্রবণে এই দুটি যৌগ তাদের বিক্রিয়া অব্যাহত রাখে। তারপর এর ফলশ্রুতিটা কি দারায়? চূড়ান্ত পর্যায়ে এমন কতগুলো যৌগ তৈরি হয় যাদের সমন্বয় ছাড়া জৈব কোষের গঠন অচিন্তনীয়। সেই গুরুত্বপূর্ণ যৌগগুলি হচ্ছে অ্যামিনো এসিড, সুগার, পিউরিন এবং পাইরিমিডিন। এই পিউরিন ও পাইরিমিডিনই নিউক্লিয়টাইডের পূর্বশর্ত। আর এই নিউক্লিয়টাইড ছাড়া জীবের বংশগতির গাঠনিক ও কার্যীক একক ডিএনএ তথা জিনের কথা অকল্পনীয়!

এই যে পরীক্ষাটি করা হল, এর তাৎপর্য কী? এরকম পরীক্ষণ অব্যাহত রেখে মানুষ কি সৃষ্টির শুরুটা অবলোকন করতে পারবে? চলে যেতে পারবে কি সেই যুগে? কিংবা পারবে কি সেই যুগে তৈরি হওয়া সর্ব প্রথম জীবটির অণুলিপি তৈরি করতে? সবগুলো প্রশ্নের একটাই উত্তর, না, এ সম্ভব নয়। কিন্তু এটা আমরা ইতোমধ্যেই জেনে গেছি যে জৈব অণু তৈরি করা আশ্চর্য রকমের সহজ কাজ। 

জীব কোষ সমূহ যে সকল অণু বা যৌগ নিয়ে গঠিত তাদের গঠন নিশ্চয়ই অনেক জটিল। জটিল যৌগ সমূহ জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়। বিক্রিয়ার পরিবেশ রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলার জন্য দায়ী। বিক্রিয়ার পরিবেশ যখন বিক্রিয়ারত অণু বা পরমাণু গুলোকে রাসায়নিক সাম্যাবস্থা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে তখন একটি রাসায়নিক বিক্রিয়া জটিল হয়ে পড়ে। যেমন, বাদী বা বিবাদীর যখন কেউই চায় না যে মামলার নিষ্পত্তি হোক কিংবা তৃতীয় কেউ যদি এ ব্যাপারে ইন্ধন যোগায় তাহলে মামলার সমাধান টানা নিশ্চয়ই অনেক জটিল হয়। সাম্যাবস্থাহীন রাসায়নিক বিক্রিয়া অনেকটা এরকমই হয়।

দুই একটি সাদামাটা জৈব অণুর নাম বলতে পারবেন কি? অ্যামিনো এসিড সমূহকে একেবারেই সাধারণ জৈব অণু বলা যেতে পারে। এর কাতারে নিউক্লিয়টাইড সমুহকেও ফেলান যায়। এই সাধারণ জৈব অণু সমূহ একীভূত হয়ে পলিমার বা বড় ধরণের অণু তৈরির সক্ষমতা রাখে। এই অ্যাসোসিয়েশন তখন কিন্তু আর সাধারণ থাকে না। তখন তারা অসাধারণ জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ে। সুতরাং জৈব অণু বলেন আর মানুষ-পশু-পক্ষী বলেন সবার পলিমারিজমে যাওয়ার উদ্দেশ্য একটাই, আর তা হল শক্তিশালী হয়ে ওঠা।

একটি অ্যামিনো এসিড অপর একটি অ্যামিনো এসিডের সাথে যুক্ত হয় পেপটাইড বন্ড বা বন্ধন দ্বারা। অপরদিকে দুটো নিউক্লিয়টাইড পরস্পরের সাথে যে বন্ধন দ্বারা যুক্ত হয় তার নাম ফসফোডায়েস্টার বন্ড। পেপটাইড বন্ডের বাড়াবাড়ি পলিপেপটাইড সৃষ্টির জন্য আর ফসফোডায়েস্টার বন্ডের বাড়াবাড়ি পলিনিউক্লিয়টাইড সৃষ্টির জন্য দায়ী। আজকের দিনে জৈব অণুর বড় বড় লম্বা লম্বা পলিপেপটাইড গুলোকে প্রোটিন বা আমিষ নামে ডাকা হয়। অপরদিকে বড় বড় পলিনিউক্লিয়টাইড গুলোর ভূমিকা আর কার্যকারিতা দুইই অভাবনীয়। আরএনএ, ডিএনএ তথা জীবের বংশগতির ধারক ও বাহক সমূহের গল্প এই লম্বা লম্বা পলিনিউক্লিয়টাইডগুলোই তৈরি করে। অত্যাবশ্যকীয় ২০টি অ্যামিনো এসিডের দ্বারা যেকোনো ধরণের প্রোটিন গঠিত হয়। অর্থাৎ যে কোন ধরণের প্রোটিনের গঠনের জন্য ২০ ধরণের অ্যামিনো এসিডের অবশ্যই প্রয়োজন হয়। আর অপর পক্ষে ডিএনএ ও আরএনএ এর প্রত্যেকেই গঠিত হয় শুধু মাত্র চার ধরণের নিউক্লিয়টাইড দ্বারা। জৈব অণু সমূহ সৃষ্টির জন্য এ সকল মনোমার বা একক অণু সমূহকে অন্যান্য অণুগুলোর থেকে কেন বেশী গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এই প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু নিশ্চিত ভাবে দেয়া যায় না। কিন্তু আমরা উক্ত পলিমারগুলোর ভূমিকা কী, কোষে এগুলো কী ধরণের তাৎপর্য রাখে এই প্রশ্নগুলো যখন বিশ্লেষণ করতে পারবো তখন তাদের বিশেষ বিশেষ কার্যকারিতাগুলো আমাদের চোখে পড়বে। আর তখনই আমরা তাদের গুরুত্বের প্রশ্নের উপলব্ধিটা ঠিকই করতে পারবো। 

জীবন সৃষ্টির প্রাক্বালে পলিমারগুলো কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল সে বিষয়ে বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন পথের কথা চিন্তা করেছেন। যেমন এটা পানি শূন্য জৈব যৌগের তাপ প্রাপ্তির মাধ্যমে হতে পারে। কিংবা হতে পারে অজৈব ফসফেটগুলোর ক্যাটালাইটিক অ্যাক্টিভিটির প্রভাবের ফলে। একটি পলিমার যখন সৃষ্টি হয়ে যায় তখন এটি তার পরবর্তী বিক্রিয়াগুলোর উপর প্রভাব ফেলতে পারে কেননা এটি তখন নিজেই ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ করে।

জীবনের উৎপত্তির জন্য বিশেষ কিছু অণুর বিন্যাসের প্রয়োজন। বিশেষ অণুগুলোকে আবার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হয়। এই বিশেষ অণুগুলোকে খুব সামান্য হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করতে হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হতে পারে বিক্রিয়াকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা এবং এটি এমন এক ধরণের ক্ষমতা যেই ক্ষমতা বলে সেই অণু নিজেই নিজের প্রতিরুপ সৃষ্টি করতে পারে। শুরুতে ক্যাটালিস্টগুলোর এই বিশেষ ধরণের স্ব-উৎপাদন প্রক্রিয়া আনুকূল্য পেয়ে থাকবে। এখানে এমন কতগুলো ক্যাটালিস্টও থাকতে পারে যারা কড়াকড়িভাবে নিজস্ব প্রতিরুপ সৃষ্টিতে নিযুক্ত থাকতে পারে। যাদের কিনা এই বিশেষ ধর্ম অন্যান্য অব্যবহৃত অণুগুলোর ভিন্ন পদার্থ সৃষ্টিতে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। এভাবে আপনি আপনার কল্পনার জগতে ক্রমবর্ধমান জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ছবি আঁকতে পারেন। যে প্রক্রিয়ার টার্গেট হবে প্রথমে জৈব মনোমার ও পরে জৈব পলিমার তৈরি। আর এই পলিমারগুলোর কাজ হবে পরস্পরের সাথে বিশেষ কার্যক্রমে জড়িয়ে যাওয়া, যেই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওরা একই ধরণের আরও নতুন অণুর সৃষ্টি করবে। সমস্ত প্রক্রিয়াটি শক্তি লাভ করবে পরিবেশ থেকে। এতক্ষণে আমরা সমগ্র প্রক্রিয়াটির একটা নামকরণ করতে পারি। ধরুন, আমি এটার নাম দিলাম "অটোক্যাটালাইটিক সিস্টেম"। এই অটোক্যাটালাইটিক সিস্টেম'টি জীবন্ত কোন বস্তুর ন্যায় কিছু ধর্ম বহন করতে পারে। যেমন, এটি পুনরুৎপাদনের ক্ষমতা রাখতে পারে, এটি অন্য একই প্রকার সিস্টেমের সাথে শক্তির উৎসের জন্য প্রতিযোগিতা করতে পারে, এমনকি এটি যদি শক্তি থেকে বঞ্চিত হয় কিংবা যদি ভুল তাপমাত্রায় চলে যায় তাহলে বিক্রিয়ার হারের ভারসাম্য রক্ষা নাও হতে পারে, এটি ধীরে ধীরে রাসায়নিক সাম্যাবস্থায় পরিক্ষয় হতে পারে এবং "নিঃশেষ" হয়ে যেতে পারে। 

কিন্তু সেই সময়ে কোন কোন অণুগুলো অটোক্যাটালাইটিক ধর্ম ধারণ করেছিল? পলিপেপটাইডগুলো আজকের দিনে জৈব কোষের সব থেকে বহুমুখী ক্যাটালিস্ট। এই পলিপেপটাইডগুলো যে বিভিন্ন ধরণের অনেকগুলো অ্যামিনো এসিড দ্বারা গঠিত সেটা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এই অ্যামিনো এসিডগুলোর নানা ধরণের রাসায়নিক পার্শ্ব শিকল রয়েছে। একই সাথে এই অ্যামিনো এসিডগুলো বিভিন্ন ধরণের ত্রিমাত্রিক গঠন লাভ করতে পারে। এই ত্রিমাত্রিক গঠন কোন সক্রিয় প্রান্তের দিকে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু যদিও পলিপেপটাইডগুলো প্রভাবক হিসেবে বহুমুখী, কোন্‌ সরাসরি সুনির্দিষ্ট উপায়ে এই অণুগুলোর একটি তার অনুরুপ সিকোয়েন্সের আরেকটি অনুরুপ অণু সৃষ্টি করবে সেই পথ আজও অজানা রয়েছে।
Share:

No comments:

Post a Comment

Why NBICT LAB?

We work on -
1. Data Science & Machine Learning;
2. Microsoft Office Applications;
3. 3D Computer Graphics & Animation;
4. Graphic Design & Multimedia;
5. Website Design & Development;
6. Research & Data Analysis;
7. Training.

Contact Us

Name

Email *

Message *

Our News